বাংলাদেশের প্রথম প্রেস মেশিন

বাংলাদেশের প্রথম প্রেস মেশিন হল কাঙ্গাল হরিনাথের প্রেস মেশিন।বাড়ির এককোণে পড়ে আছে সেই প্রেস, যাতে রয়েছে কাঙাল হরিনাথের জীবনস্মৃতি। রয়েছে সাঁইজী লালন, মীর মশাররফ ও জলধর সেন প্রমূখ জগতবিখ্যাত ব্যক্তির হাতের স্পর্শ। ‘বাংলা মুদ্রণ যন্ত্র’ নামের যে যন্ত্রটিতে তিনি ১৮৭৩ সালে গ্রামবার্ত্তা ছাপিয়ে ছিলেন, সেটি দর্শনার্থীদের জন্য এখনও তাঁর বাড়িতে রাখা আছে।

ঊনবিংশ শতকের নির্ভীক সাংবাদিক ছিলেন কাঙাল হরিনাথ। তিনি কুষ্টিয়ার প্রথম সংবাদপত্র ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র সম্পাদক ছিলেন। তাঁকে বিবেচনা করা হয়, গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ হিসেবে।

হরিনাথ মজুমদারের জন্ম ১৮৩৩ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কুন্ডুপাড়ায় এবং ১৮৯৬ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এখন তার স্মৃতি বলতে অবশিষ্ট রয়েছে ঐতিহাসিক ছাপার যন্ত্র, এমএন প্রেস, হাত মেশিন, বাংলা টাইপ ও হরিনাথের কিছু পান্ডুুলিপি।

অল্প বয়সেই তিনি পিতা-মাতাকে হারিয়েছিলেন। স্থানীয় ইংরেজি স্কুলে শুরু হয় তার পড়ালেখা। তবে অনাথ হয়ে পড়ায় আর্থিক দুর্গতিতে লেখাপড়া বেশিদূর এগোয় না। তিনি একইসাথে বিদ্যানুরাগ ও সমাজ-সচেতনতা ছিলেন। নিজ গ্রামে তিনি বন্ধুবান্ধবের সহায়তায় একটি ভার্নাকুলার স্কুল খুলেছিলেন ১৮৫৫ সালে। সেখানেই অবৈতনিক শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। পরের বছর তিনি কুমারখালীতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন।

১৮৫৮ সালে এই বালিকা বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এ দেশে নারীদের শিক্ষার প্রসারেও হরিনাথের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। স্থানীয় জমিদার ও ইংরেজদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি ঈশ্বরগুপ্তের সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। সেই তার সাংবাদিকতার শুরু। পরে ১৮৬৩ সালে নিজেই প্রকাশ করেন গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা নামের মাসিক পত্রিকা। পরে এটি পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয়।

গ্রামবার্ত্তা প্রথমে প্রকাশিত হতো কলকাতার গীরিশ বিদ্যারত্ন প্রেস থেকে। বাংলা পিডিয়ার তথ্যানুসারে, ১৮৬৪ সালে কুমারখালীতে স্থাপিত হয় মথুরনাথ যন্ত্র। বিখ্যাত ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রের পিতা হরিনাথের বন্ধু মথুরনাথ মৈত্র এটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তিনি মুদ্রণযন্ত্রটি হরিনাথকে দান করেন। ১৮৭৩ সাল থেকে এই যন্ত্রেই গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিত হতে থাকে। ২৫ বছর ধরে পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছিল।

বিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সুযোগও হয়নি কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের। কিন্তু জ্ঞান অর্জনের অদম্য স্পৃহা তাঁকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। নিজ চেষ্টায় তিনি সত্যিকারের জ্ঞানী হয়ে উঠেছিলেন।

পারিবারিক দৈন্যের কারণে বালক বয়সে কুমারখালী বাজারের এক কাপড়ের দোকানে কাঙাল হরিনাথ কাজ নিতে বাধ্য হন দৈনিক দুই পয়সা বেতনে। এরপর ৫১টি কুঠির হেড অফিস কুমারখালীর নীলকুঠিতে শিক্ষানবিস হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু মানবদরদি ও সত্যনিষ্ঠ হরিনাথের পক্ষে সেখানেও বেশিদিন কাজ করা সম্ভব হয়নি। নীলকুঠিরে স্বল্পকালীন কর্মজীবনে হরিনাথ রায়ত-প্রজার ওপর কুঠিয়ালদের অত্যাচার ও শোষণের স্বরূপ নিজ চোখে দেখেন।

ধারণা করা হয়, এই শোষণের প্রতিকারের চিন্তা থেকেই পরে হরিনাথ মজুমদার ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ সম্পাদনা করেন। গণসংগীত শিল্পী কমরেড হেমাঙ্গ বিশ্বাস তার এক লেখায় উল্লেখ করেন, ‘রবীন্দ্রনাথের আগে ঠাকুর পরিবারের যেসব সদস্য জমিদার হিসেবে শিলাইদহে এসেছিলেন, তারা প্রজাবৎসল ছিলেন না। তাদের অত্যাচারের কথা হরিনাথ গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায় সাহসের সঙ্গে লিখতেন।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.