সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা কক্সবাজারে সার্ফিং

কক্সবাজার সৈকতের কলাতলী পয়েন্টের বালুচরে সার্ফিং বোর্ডে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো ১০ জনের দল। সামনে থাকা প্রশিক্ষক বুঝিয়ে দিচ্ছেন নানা কৌশল। মনোযোগী খুদে শ্রোতারা। বুঝে নিচ্ছে খুঁটিনাটি। এভাবে আধা ঘণ্টার তাত্ত্বিক পাঠদান শেষে ব্যবহারিক। সমুদ্রের পানিতে ভেসে বেড়ানোর চেষ্টা। কখনও পড়ে যাচ্ছে পানিতে। আবার বোর্ডে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা। তাদের সাহায্য করছে বড়রা।

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে এভাবেই চলছে সার্ফারদের প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন সার্ফার মো. সাইফুল্লাহ সিফাত। বাংলাদেশ সার্ফিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। ভারসাম্য, নমনীয়তা ও সহনশীলতা- এই তিনটি গুণ একজন সার্ফারের অবশ্যই থাকা প্রয়োজন উল্লেখ করে সাইফুল্লাহ সিফাত বলেন, ‘ছেলেদের পাশাপাশি এখন সার্ফিংয়ে কক্সবাজারের মেয়েরাও এগিয়ে আসছেন। যাঁরা এগিয়ে আসছেন, তাঁদের ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে কক্সবাজার সৈকতে।’

সার্ফিংয়ের আদর্শ জায়গা
গর্জন তোলা সমুদ্রের ঢেউ বেয়ে লাফিয়ে ওঠার রোমাঞ্চকর জলনৃত্য উপভোগ কিংবা সৈকতে আসা পর্যটকদের চিত্তবিনোদন খোরাকই শুধু নয়, সমুদ্রে নামা মানুষের জীবন রক্ষাকারী হিসেবেও কাজ করছেন সার্ফাররা। কেউ কেউ আবার একেবারেই লাইফ সেভিংয়ের কাজ করছেন। এ প্রসঙ্গে সাইফুল্লাহ সিফাত বলেন, ‘তিন কারণে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার সার্ফিংয়ের আকর্ষণের জায়গা। এর একটি হলো স্বচ্ছ নীল জলের ঢেউ; দ্বিতীয়ত, পানির নিচে নেই পাথরসহ কঠিন বা ধারালো কিছু, যা দ্বারা আঘাত পাওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং তৃতীয়ত, কক্সবাজারে হাঙর-তিমিসহ সামুদ্রিক ভয়ংকর প্রাণী না থাকা।’

যেভাবে যাত্রা শুরু
১৯৯৬ সালের কথা। কক্সবাজার সৈকতের পাশ দিয়ে সার্ফ বোর্ড নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন এক অস্ট্রেলিয়ান সার্ফার। সার্ফ বোর্ড দেখে খুব অদ্ভুত লেগেছিল জাফর আলমের কাছে। জাফর সৈকতের তীরের বাহারছড়া এলাকার বাসিন্দা। পিছু নেন ওই অস্ট্রেলিয়ানের। তিনি জাফর আলমের আগ্রহ দেখে কিছু একটা বুঝতে পারলেন। কিন্তু তাঁদের দু’জনের ভাব বিনিময়ের জন্য ভাষার মিল নেই।

কেউ কাউকে কিছু বলতে পারছেন না। কিন্তু বুঝতে পারছেন ঠিকই। অস্ট্রেলিয়ান বুঝলেন, ছেলেটি সার্ফ বোর্ড দেখে পিছু নিয়েছে। জাফর আলম বুঝলেন, অস্ট্রেলিয়ান সার্ফ বোর্ডটি দিতে পারেন টাকার বিনিময়ে। তখন ওই অস্ট্রেলিয়ানের কিছু বাংলাদেশি টাকারও দরকার ছিল। জাফর সৈকতের পাশে হালকা ভেজা বালুর ওপর লিখলেন ‘২০০০ টাকা’। এতেই বুঝে গেলেন অস্ট্রেলিয়ান। মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এসে জাফর আলম কিনে ফেললেন সেই সার্ফ বোর্ড। কিন্তু এই বোর্ডের কাজ কী, কী হয় এই বোর্ড দিয়ে অথবা এটি দিয়ে কেমন করে খেলা যায়- এর কিছুই জানা ছিল না তাঁর।

পরে সেই বোর্ড দিয়ে সৈকতে খেলতে থাকেন তরুণ জাফর আলম। সৈকতের ঢেউয়ে বোর্ড নিয়ে ভাসতে থাকলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, ঢেউ এলেও সার্ফ বোর্ড ধরে ভেসে থাকা যায় আর ঢেউয়ের মধ্যে টানলে এটার গতি আরও বাড়ে। কিন্তু এর আর কোনো কৌশল তাঁর জানা নেই। কেউ ঢেউয়ে এটা নিয়ে খেলেছে, এমনটি কোথাও দেখেননি। এভাবে ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সার্ফিং বোর্ড নিয়ে খেলতে থাকেন জাফর। সেই জাফর আজ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সার্ফার। ২০০০ সালের দিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সৈকতের অনেক শিশু হকার সার্ফিংয়ে যোগ দেয়। এখন তারা যেন একেকজন সাগরযোদ্ধা।

দেশীয় সার্ফিং বোর্ড
কক্সবাজারের অধিকাংশ সার্ফারের মতো মোহাম্মদ আলমগীরের জীবনটাও সাদামাটা। রোজকার কাজ শেষে সার্ফিং বোর্ড নিয়ে নেমে পড়তেন নোনাজলে। তবে এই তরুণ সার্ফার সবার নজর কেড়েছেন সার্ফিং বোর্ড তৈরি করে। দেশীয় উপকরণ দিয়েই তিনি বানিয়েছেন মানসম্পন্ন সার্ফিং ও উদ্ধারকারী বোর্ড। ২০১১ সালের কথা। সৈকতে তখন ওয়াটার বাইক চালান আলমগীর। বিকেল হলেই লাবনী পয়েন্টে আসতেন সার্ফার জাফর আলম। দলবল নিয়ে শুরু করেন সার্ফিং। কাছ থেকে আগ্রহ নিয়ে দেখেন ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার রোমাঞ্চ। একসময় জাফর আলমের দলের সদস্য হয়ে যান ১৮ বছর বয়সী আলমগীর।

সার্ফিংয়ে তো হাতেখড়ি হলেও তাঁর নিজের সার্ফিং বোর্ড নেই। আর দশজন সার্ফারের অবস্থাও তাঁর মতোই। ব্যয়বহুল সার্ফিং বোর্ড সবার থাকার কথাও নয়। তবু একটি সার্ফিং বোর্ডের আকাঙ্ক্ষা আলমগীরকে পেয়ে বসে। ততদিনে তাঁর সার্ফার জীবনের তিন বছর। ২০১৪ সালের মে মাসে নিজেই সার্ফিং বোর্ড বানানোর উদ্যোগ নিলেন। প্লাইউড, ফোম, ফাইবার গ্লাসসহ সব উপকরণ নিয়ে শুরু হলো বোর্ড বানানোর কাজ। কিন্তু ১৮ দিনের পরিশ্রমের পর আলমগীর প্রথমে সার্ফিং বোর্ড না বানিয়ে বানালেন রেসকিউ বোর্ড। পরে সংশ্নিষ্টদের সহায়তায় আরও উন্নতমানের সার্ফিং ও রেসকিউ বোর্ড বানানো শুরু করেন।

রোমাঞ্চকর জীবন
সার্ফিংকে এগিয়ে নিতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সার্ফিং অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কক্সবাজারে। আন্তর্জাতিক সার্ফিং সংস্থার সদস্যপদও পেয়েছে সংগঠনটি। এখন সার্ফিং ট্রেনিং গ্রাউন্ড হিসেবে পরিচিত কক্সবাজার সৈকত। বিদেশিরাও এখানে সার্ফিংয়ের জন্য আসেন। যোগাযোগ করেন বাংলাদেশ সার্ফিং অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে। ছেলেদের পাশাপাশি কক্সবাজারের মেয়েরাও এগিয়ে আসছেন সার্ফিংয়ে। বর্তমানে কক্সবাজারের ছোট-বড় ১৫০ জন সার্ফার স্বপ্ন বুকে নিয়েই নোনাজলে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন।

চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
কক্সবাজারে সার্ফিংয়ের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে এবং এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে পর্যটননগরীকে ভিন্ন আঙ্গিকে গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্নিষ্টরা। এতে পর্যটনের সম্ভাবনা যেমন বাড়বে, তেমনি সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান, বাড়বে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার নাগরিক সমাজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, ‘সার্ফিং উন্নত বিশ্বের অত্যন্ত জনপ্রিয় খেলা। কক্সবাজার সমুদ্র সার্ফিংয়ের জন্য উপযুক্ত। সার্ফিংয়ের মাধ্যমে কক্সবাজারকে বিশ্বে তুলে ধরা যাবে। এটিকে কেন্দ্র করে কক্সবাজারে আরও বেশি বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করা যাবে।’

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.