অবিরাম বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে বন্যা। প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলার নতুন নতুন এলাকা। ভাঙছে সড়ক-মহাসড়ক, বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ হাট-বাজার। নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে মানুষ। ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে বন্যা-কবলিতরা। এদিকে বানের পানিতে তলিয়ে গেছে সরাইল-অরূয়াইল সড়ক। এতে গতকাল থেকে ওই সড়কে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ওদিকে বন্যায় নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে অষ্টগ্রামের একের পর এক বাড়িঘর।
ভাঙছে সদ্য নির্মিত রাস্তা। জামালপুরে তৃতীয় বারের মতো বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় যমুনার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৯৭ সে.মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বকশীগঞ্জে বন্যার পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এদিকে পদ্মায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় মাদারীপুরের চরাঞ্চলে ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। ঘরবাড়ি ভেঙে নিরাপদ স্থানে ছুটে যাচ্ছে চরাঞ্চলের অসংখ্য মানুষ। এছাড়াও পানিবন্দি হয়ে পরেছে হাজার হাজার মানুষ। ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় গবাদি পশু নিয়ে দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছে চরাঞ্চলের মানুষেরা। ওদিকে মেঘনার তীব্র ভাঙনে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে চারটি ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। রাক্ষুসে মেঘনা ইতিমধ্যে গিলে খেয়েছে চরকালকিনি, সাহেবেরহাট, চরফলকন ও পাটারিরহাট ইউনিয়নের ৩৬ ওয়ার্ডের মধ্যে ১০টি ওয়ার্ড। গঙ্গাচড়ায় তিনশতাধিক বাড়িঘর তিস্তায় বিলীন হয়ে গেছে।
এদিকে বাংলাদেশে ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর এবারের বন্যাই সব থেকে বেশি সময় ধরে স্থায়ী হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। মঙ্গলবার জাতিসংঘের কো-অর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্স বা ওসিএইচএ তাদের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এ আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। এতে তারা বলেছে, বন্যায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ১৮টি জেলায় ২৪ লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি জানান, অবশেষে বানের পানিতে তলিয়ে গেছে সরাইল-অরূয়াইল সড়ক। গতকাল থেকে ওই সড়কে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গত বুধবার থেকে পানির কারণে সড়কে ফেসে যাচ্ছিল যানবাহন। বন্যা কেড়ে নিয়েছে সরাইলের ভাটি এলাকা খ্যাত তিন ইউনিয়নের কয়েক লাখ মানুষের স্বপ্ন। এখন পানির স্রোতে সড়কটি হাওরে বিলীন হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে স্বপ্নের এ সড়ক টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।
সরজমিন দেখা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে চুন্টা এলাকা থেকেই সড়কটির কিছু জায়গা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। আর ভূঁইশ্বর বাজার থেকে কালিশিমুল পর্যন্ত এক দেড় কিলোমিটার সড়কের উপর প্রায় আধা ফুট পানি। সড়কের উপরে পানির স্রোতের কারণে হাওর ও সড়ক চেনা দায়। বাড়িঘরের সীমানা আন্দাজ করে সিএনজি চালিত অটোরিকশা, মোটরবাইকসহ অন্যান্য যানবাহন গত বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত চলেছে ঝুঁকি নিয়ে। রাতে পানি আরো বৃদ্ধি পাওয়ায় গতকাল ভোর থেকে আর যানবাহন চলতে পারছে না।
অষ্টগ্রাম (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে অষ্টগ্রামের একের পর এক বসতঘর। ভাঙছে সদ্য নির্মিত রাস্তা। বিগত অর্থবছর ২০১৬-১৭-১৮ ইং সালের অধিকাংশ রাস্তার পাশের সদ্য নির্মিত ব্লক সরে গিয়ে চলাচলের রাস্তার ভাঙন ধরেছে। এতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর অতি বর্ষার পানিতে বিভিন্ন রাস্তায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় জনজীবনও বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এ বিষয়ে অষ্টগ্রাম উপজেলা প্রকৌশলী মাহবুব মুর্শেদ জানান, বিষয়টি সরজমিন দেখে জেলা প্রকৌশলীকে অবগত করেছেন। তবে তৎক্ষণাৎ সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট যথা সম্ভব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ব্লক সরে গিয়ে রাস্তার ভাঙার মেরামত করতে দীর্ঘ সময় হতে পারে। অষ্টগ্রাম উপজেলায় ৫টি ইউনিয়নের সংযোগ অলওয়েদার সড়ক রয়েছে প্রায় ৩০ কিলোমিটারের অধিক। এসব সড়কের রাস্তার পাশের ব্লক সরে যাওয়ায় ভেতরের বালু ধসে পানির সঙ্গে মিশে যায়। এতে চলাচলের রাস্তাটি শূন্যর মাঝে ভেসে থাকে। যেকোনো সময় রাস্তাটি ভেঙে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিছু কিছু সড়কে যান চলাচলের নিষিদ্ধ করে বাঁশ দিয়ে পথ রোধ করা হয়। গত কিছুদিন পূর্বে নবনির্মিত উপজেলা সম্প্রসারিত প্রশাসনিক ভবনের চারপাশে ব্লক দিয়ে নির্মিত করা হলে সেটিও ভেঙে গিয়ে মাটি সরে যাচ্ছে। এরকম দেওঘর ইউনিয়নের সাভিয়ানগর হতে আলীনগর, দেওঘর পশ্চিম পাড়া, কুরেরপাড় হতে বাঙ্গালপাড়া, কাস্তুল ইউনিয়নের বাাহাদুরপুর, ব্রহ্মপুরা, পূর্ব-অষ্টগ্রাম ইউনিয়নসহ অসংখ্য রাস্তা রয়েছে। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন এলাকায় প্লাবিত হচ্ছে। উপজেলার অধিকাংশ এলাকায় পানি বৃদ্ধির কারণে সংকিত রয়েছে জনগণ। কিছু প্লাবিত এলাকা দেওঘর পশ্চিমপাড়া, বাহাদুরপুর পূর্বপাড়া, ভাতশালা উত্তরপাড়া, পাওন কান্দি পূর্বপাড়াসহ অসংখ্য খণ্ড খণ্ড বসতবাড়ি পানিতে ডুবে যায়। অতি বৃষ্টি আর প্রবল বর্ষার পানি বৃদ্ধির কারণে উপজেলা অষ্টগ্রামের অধিকাংশ রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে।
গঙ্গাচড়া (রংপুর) প্রতিনিধি জানান, ‘ত্রাণ নয়, বাড়ি করি থাকার মতো জায়গা চাই, থাকার জায়গা না থাকলে বাড়ি করে থাকমো কোটে আর ত্রাণ নিয়ে রান্না বা করি কোটে খামো। এভাবে কান্না জড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চর শংকরদহ গ্রামের তিস্তায় ভাঙনে বিলীন হওয়া মিটু মিয়া।’ মিটুর মতো ওই গ্রামের এজাজুল মুন্সি, হালিম, তালেব, জয়নাল, নুর আলম, হয়রত, সিরাজুল, হাসান, দুলু, দুলাল, খরকু, নুর ইসলাম, ছমসেল, লাবলু, খোকা, মনোয়ারুল, জয়নাল, বাবলু, রশিদ, নুর আলম, আক্তারুলসহ প্রায় ৩ শতাধিক পরিবার তিস্তার কয়েক দফায় ভাঙনে বাড়িঘর বিলীন হয়ে গেছে। এখন শুধু মানচিত্রে নাম আছে শংকরদহ, কিন্তু বাস্তবে গ্রামটি আর নেই। আর ৭০-৮০টি বাড়ি গ্রামটির ভেঙে যাওয়ার পথে। বর্তমানে নামে আর আর মুখে ওই ক’টি বাড়ি শংকরদহ স্মৃতি ধরে আছে। তিস্তা যেভাবে ভাঙছে তাতে যেকোনো সময় সে বাড়িগুলো বিলীন হয়ে শংকরদহ পুরো গ্রাম হারিয়ে যাবে। এরেই মধ্যে শংকরদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বিলীন হয়ে গেছে। বিলীনের অপেক্ষায় শংকরদহ বধ্যভূমি ও হাফিজিয়া মাদ্রাসা। এবারের বর্ষা মৌসুমে দফায় দফায় বন্যা আর বন্যার পানি কমানোর সঙ্গে তিস্তার ভাঙন। তিস্তার ভাঙনে উপজেলার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চর শংকরদহ, ইচলী, আশ্রয় গ্রাম, বাগেরহাট, চল্লিশসাল, কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনা, চিলাখাল, খলাইচর, নোহালী ইউনিয়নের ফোটামারী, বৈরাতী, নোহালীর চর, আলমবিদিতর ইউনিয়নের গাটুপাড়া, হাজীপাড়া, পীরপাড়া, গজঘণ্টা ইউনিয়নের ছালাপাক, কামদেব, রাজবল্লভ, মহিষাশুর, মর্ণেয়া ইউনিয়নের তালপট্টি, ভাঙাগড়া, আলালচর, নরসিং, আলেমার বাজারসহ তিস্তাবেষ্টিত বিভিন্ন এলাকায় তিস্তার ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। ফসলি জমিসহ ওইসব মানুষের ঘরবাড়ি, গাছপালা, রাস্তা ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট ভেঙে গেছে। চরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মানুষজন নৌকায় কোনো রকম চলাচল করছে। বাড়ি ভাঙা মানুষগুলো কোনো রকম এক-দুটা ঘর ও কিছু জিনিসপত্র সরিয়ে নিলেও তাদের বাড়ি নির্মাণ করে থাকার মতো জায়গা না পেয়ে এসব ঘর রাস্তার ধারে ফেলে রেখেছে। আবার অনেকে জায়গা না পেয়ে তিস্তার আরেক চরে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় বাড়ি তৈরি করছে। সরকারিভাবে বাড়ি ভাঙা ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হলে কোনো বাড়ি ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার এখন পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়নি।
জামালপুর প্রতিনিধি: উজানের পাহাড়ি ঢল আর অবিরাম বৃষ্টির ফলে জামালপুরে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির তৃতীয় বারের মতো অবনতি হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় যমুনার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৯৭ সে.মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির আবারো অবনতি হয়েছে। জেলার সাত উপজেলার ৮ পৌরসভা ও ৬৮ ইউনিয়নের মধ্যে এখন ৬২টি ইউনিয়নের ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। তার সঙ্গে তীব্র খাদ্য সংকট ও বিশুদ্ধ পানির অভাব তাদের কষ্টের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।
যমুনা নদীর পানি তৃতীয় বারের মতো বৃহস্পতিবার ১৩ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৯৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়াও ব্রক্ষপুত্র ঝিনাইসহ অন্য শাখা নদীর পানি বৃদ্ধিও অব্যাহত রয়েছে। জেলায় বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার ফলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বেড়েই চলছে। এরই মধ্যে ১৩ হাজার হেক্টর বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, গোচারণ ভূমি, বসতবাড়ি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ গ্রামীণ হাটবাজার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ১৭শ’ কিলোমিটার সড়ক বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এছাড়ও দুর্গত এলাকায় গোখাদ্যের সংকটের পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়েছে পানিবাহিত রোগ। ফুলে-ফেঁপে উঠা পানিতে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অধিকাংশ মানুষ। চারদিকে থই থই পানি আর ক্ষুধার জ্বালায় তাদের জীবন হয়েছে দুর্বিষহ।