ভারতের প্রথম ডাকঘর মেদিনীপুরের খেজুরিতে, সংরক্ষণের অভাবে ধুঁকছে সেই ইতিহাস

কলকাতা থেকে মোটামুটি ১২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে গেলে, পূর্ব মেদিনীপুরের একটি ছোট্ট গ্রাম খেজুরি। সুন্দর, বাড়িঘর, সবুজে ঘেরা বাংলার চিরন্তন গ্রামীণ ছবি। এবার গ্রামে একটু হাঁটতে বেরোলেন আপনি। এদিক সেদিক দেখার পর, হঠাৎই একটি জিনিস নজরে এল। বন জঙ্গলের মাঝে কিছু ভাঙাচোরা বাড়ি। বাড়ি তো নয়, ধ্বংসাবশেষ। হয়ত একসময় কারোর ঘর ছিল, এখন অযত্নে এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। যেন জিগস পাজলের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরোটা; সাজিয়ে নিলেই হল। কিন্তু খেজুরির এই ঘন বনের ভেতর, এমন কী ছিল? এর উত্তর পেতে হলে খানিক ইতিহাসের পাতা ওলটাতে হবে। যত দেখবেন, ততই ভাববেন আমরা এখনও আমাদের প্রাচীন স্থাপত্য, ইতিহাস নিয়ে এতটা উদাসীন?

একটু খোলসা করতে করতে আমাদের যাত্রা শুরু করা যাক। একটু পেছনে ফিরলেই দেখবেন, খেজুরির এই ভাঙা বাড়িটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের ভারতের ডাক ব্যবস্থার বিস্তারের। ‘রানার ছুটেছে’— আর খেজুরি দিয়েই এই দৌড় শুরু হয়েছিল। এই ভগ্ন স্থাপত্যটি আর কিছুই নয়, ভারতের প্রথম ডাকঘরের। খেজুরিতেই ইংরেজদের হাত ধরে সূচনা হয়েছিল দেশের ডাকব্যবস্থার, এই বাড়ি থেকেই। তখন আর কে জানত, একবিংশ শতাব্দীতে এসে তিনতলা ডাকঘরটির এমন অবস্থা হবে!

১৬’শ বা ১৭’শ শতকে একটু ফিরে গেলে দেখা যাবে, মেদিনীপুরের ওই জায়গার বর্তমান চেহারার সঙ্গে ওই সময়ের কোনো মিল নেই। তখনও বেশ কিছুটা অংশ জলের তলায়। সবেমাত্র দুটি দ্বীপ উঠেছে। একটি হল হিজলি, অন্যটি খেজুরি। পরে আর এটা দ্বীপ থাকে না। যাই হোক, নবাবি আমলে এই জায়গাগুলি ছিল নুনপট্টি; অর্থাৎ এখানে মোহনার জল থেকে নুন তৈরি করা হত। ধীরে ধীরে বিদেশি জাহাজ আসতে থাকে ভারতে। ইউরোপের নানা দেশ থেকে মানুষজন হাজির হন এখানে। সেভাবেই ১৭’শ শতকের মোটামুটি শেষের দিকে হাজির হয় পর্তুগিজরা। তৈরি করে বন্দর। আস্তে আস্তে ব্যবসাও বাড়তে থাকে।

সবই তো হল, কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা তো স্থাপন করতে হবে। ততদিনে ভারতে উপনিবেশ স্থাপনের স্বপ্ন দেখে শুরু করেছে অনেকে। সেই স্বপ্নের রাস্তায় এসে ঢুকল আরও একটি নাম। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। কী করে গোটা বাংলা ও ভারত অধিকার করল ইংরেজরা, সে গল্প তো শুনেছেনই। বণিক জাত, কোন বন্দর ভালো, কোনটা খারাপ ভালোই জানে তাঁরা। খেজুরি তখন নেকনজরে পড়ল ইংরেজদের। এরপরই শুরু হল ডাকঘর তৈরির কাজ। ইউরোপের অন্যান্য অংশের সঙ্গে তো ভারতের যোগাযোগ থাকতে হবে। ইংরেজদেরও যে খবর নিতে হবে। ব্যস, ১৮০০ সালে দেশের প্রথম ডাকঘরটি তৈরি হয় খেজুরি।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

%d bloggers like this: