গাছগাছালিতে ঢাকা এ উদ্যানের প্রতিটি জায়গাই নজরকাড়া। সারি সারি বৃক্ষের মাঝে পায়ে চলা পথ। হাঁটতে হাঁটতেক্লান্ত হয়ে পড়লে বিশ্রামের জন্য আছে বেঞ্চ কিংবা ছাউনি। বনের মাঝে কোথাও কোথাও চোখে পড়বে ধানক্ষেত।কোথাও আবার পুকুর কিংবা ছোট আকারের লেক।
গাছের সারির মাঝে পায়ে চলার পথ। বনের নির্জনতা উপভোগ করার মতো। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়লেবেঞ্চিতে বসে বিশ্রাম নিতে পারবেন। ছবি তোলার জন্য নিঃসন্দেহে চমৎকার একটি জায়গা। ছোট ছোট ছাউনি করাহয়েছে ভ্রমণকারীদের জন্য। বনের মাঝে কোথাও কোথাও চোখে পড়বে ধানক্ষেত। কোথাও আবার পুকুর কিংবা ছোটআকারের লেক।
ঢাকার খুব কাছে সবুজ ছায়া ঘেরা বনে নিশ্বাস নিতে চাইলে জয়দেবপুরের ভাওয়াল ন্যাশনাল পার্কের চেয়ে চমৎকারজায়গা আর হয় না! ঢাকা থেকে দূরত্ব মাত্র চল্লিশ কিলোমিটার আর গাজীপুর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার। একদিনেবন ঘুরে আবার ফিরেও আসতে পারবেন। গাছগাছালিতে ঢাকা এ উদ্যানের প্রতিটি জায়গাই নজরকাড়া।
বনভোজন ছাড়াও দিনে গিয়ে দিনে বেড়িয়ে আসা যায়।
বাংলাদেশের মোট ১৭টি জাতীয় উদ্যানের অন্যতম ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান। ১৯৭৪ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু হলেওএকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে প্রজ্ঞাপন জারী করা হয় ১৯৮২ সালের ১১ মে। অনিন্দ্য সুন্দর এই উদ্যানটি মূলতগ্রীষ্মমন্ডলীয় আর্দ্র পত্র পতনশীল বন। শাল বা গজারি এই উদ্যানের প্রধান বৃক্ষ। শাল বনের বৈচিত্রময় রুপমাধুরী আরজঙ্গলের স্বাদ অনুভবের জন্য প্রত্যেক বছর এখানে আসেন কয়েক লাখ পর্যটক। সৌন্দর্য, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ঠ্য আরবৈচিত্রময়তার জন্য অনন্য এ উদ্যানের জুড়ি নেই।
ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের অবস্থান :–
ঢাকার পাশের জেলা গাজীপুরের সদর ও শ্রীপুর উপজেলা জুড়ে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের অবস্থান। ঢাকা থেকে এরদূরত্ব মাত্র চল্লিশ কিলোমিটার। পুরো পরিকল্পনায় যদিও গাজীপুর সদর ও শ্রীপুর উপজেলার ৩৫টি মৌজা ও ১৩৬টিগ্রামের ৫০২২ হেক্টর জায়গাজুড়ে জাতীয় উদ্যানের অবস্থান, তবে মূল উদ্যানটি মূলত ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কেরপাশে ৯৪০ হেক্টর জমির উপর অবস্থিত।
ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান প্রতিদিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খোলা থাকে।
দর্শনীয় স্থান :–
ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের ভেতরে আছে ১৯টি বিশ্রামাগার ও কটেজ।এগুলোর নামও বেশ মজার।
- চম্পা,
- জেসমিন,
- অর্কিড,
- রজনীগন্ধা,
- শাপলা,
- মালঞ্চ,
- গোলাপ,
- মাধবী,
- বকুল,
- জুঁই,
- চামেলী,
- বেলি,
- আনন্দ-১,
- আনন্দ-২,
- আনন্দ -৩,
- শ্রান্তি ও
- কেয়া।
এছাড়া বনের ভেতরে আছে ৩১টি বনভোজন কেন্দ্র।এগুলো হল:
- সোনালু,
- পলাশ,
- কাঞ্চন,
- মহুয়া,
- শিমুল-১,
- শিমুল-২,
- শিউলি-১,
- শিউলী-২,
- নিরিবিলি-১,
- নিরিবিলি-২,
- নিরিবিলি-৩,
- নিরিবিলি-৪,
- বনশ্রী-১,
- বনশ্রী-২,
- বনশ্রী-৩,
- বনশ্রী-৪,
- বনরূপা-১,
- বনরূপা-২,
- বনরূপা-৩,
- কদম,
- অবকাশ-১,
- অবকাশ-২,
- অবকাশ-৩,
- অবকাশ-৪,
- অবকাশ-৫,
- অবকাশ-৬,
- অবকাশ-৭,
- অবকাশ-৮,
- অবকাশ-৯,
- অবকাশ-১০
- আনন্দ।
নামের ভিন্নতার সঙ্গে এগুলোর পরিবেশও ভিন্ন আমেজের। পিকনিক স্পট কিংবা কটেজ ব্যবহার করতে হলে বনবিভাগের মহাখালী কার্যালয় (০২-৯৮৯৯৪৯৭) থেকে আগাম বুকিং দিতে হবে।
একসময় ভাওয়াল উদ্যানে পাওয়া যেত ব্ল্যাক প্যান্থার, চিতা বাঘ, ময়ূর, হাতি। এসব এখন ইতিহাস।
ক্রমাগত বন উজাড়ের ফলে দিনে দিনে এর পরিধি কমে আসায় বন থেকে বিলুপ্ত হয়েছে নানান বন্যপ্রাণী। তবেবাংলাদেশ সরকার এই বন সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয় স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে।
ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের মূল উদ্ভিদ হল শাল।
প্রায় ২২০ প্রজাতির গাছপালা আছে এই বনে।
এর মধ্যে ৪৩ প্রজাতির বিভিন্ন রকম গাছ,
১৯ প্রজাতির গুল্ম, তিন প্রজাতির পাম,
২৭ প্রজাতির ঘাস,
২৪ প্রজাতির লতা,
১০৪ প্রজাতির ঔষধি গাছ। জীব বৈচিত্র্যেও কমতি নেই এই বনে।
প্রায় ১৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী,
নয় প্রজাতির সরীসৃপ,
পাঁচ প্রজাতির পাখি
পাঁচ প্রজাতির উভচর প্রাণীও রয়েছে এই বনে।
ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান একটি প্রাকৃতিক বনভূমি। রুপ, বৈচিত্র ও বহুমাত্রিক প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের জন্য এই উদ্যানটিঅনন্য। পাতা ঝরা বৃক্ষের এই বন সময়ে সময়ে পাল্টায় তার রুপের বাহার। শালবৃক্ষের মায়ায় ঢাকা এই উদ্যানেগেলেই চোখে পড়বে ঘন বন, ঝোপ-জঙ্গল।
শীতকালে যদিও পাতা পড়ে গিয়ে বনের রুপে শূন্যতার আবহ নিয়ে আসে, কিন্তু অন্যান্য মৌসুমগুলোতে চোখেপড়বে গাঢ় সবুজের মনলোভা সৌন্দর্য।
উদ্যানের ভেতরে হাঁটার জন্য রয়েছে পরিকল্পিত রাস্তা ও হাইকিং ট্রেইল। উদ্যানের বুক চিরে সর্পিল ফসলি জমিরঅবস্থান। গহীন অরণ্যের মাঝ দিয়ে হেঁটে হেঁটে উপভোগ করা যায় নির্জনতার স্বাদ।
উদ্যানের মোহনীয়তাকে পূর্ণ করেছে কয়েক মাইল বিস্তৃত বিশালাকার কয়েকটি লেক, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছেপদ্মপুকুর। এই লেকটিতে পদ্মফুলের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য হৃদয়কাড়া।
সেই সাথে অরণ্যের গাঢ় সবুজে জলের সমাহার এই উদ্যানের সৌন্দর্যকে করেছে অনন্য। লেকগুলোতে নৌকাভ্রমণের স্বাদ নিতে পারবেন, আবার ইচ্ছে করলে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার ব্যবস্থাও আছে, যদিও সেজন্য একটি নির্দিষ্টঅংকের অর্থ গুনতে হবে আপনাকে।
এখানকার মাটির রং ধূসর, যাকে বলা হয় লালমাটি। শুকনো অবস্থায় এই মাটি ইটের মতো শক্ত হলেও পানিরসংস্পর্শে গা এলিয়ে দেয়। মাটির রং ধূসর হওয়ার কিন্তু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। এই এলাকার মাটিতে অম্লত্বেরপরিমাণ অনেক বেশি, প্রায় ৫.৫ পিএইচ। এই বনটি পত্র পতনশীল বন হওয়ার কারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেব্যাপারটি ঘটে তা হলো ঝরা পাতাগুলো মাটিতে পড়ে হিউমাস তৈরি করে ও মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে, ফলে খুবসহজেই এখানে জন্মায় নানাবিধ বৃক্ষ, লতাপাতা।
উদ্ভিদ ও প্রাণীবৈচিত্র
উদ্যানে শনাক্ত করা পাখিগুলোর মধ্যে হিরগল, লালচিল, বক, দোয়েল, হটটিটি, মাছরাঙা, কুরা ঈগল, হাড়ি চাচা, বেনেবৌ, বুলবুল, নীলকন্ঠ, কাক, শালিক, চড়ুই, পেঁচা, টিয়া, মৌটুসী, পানকৌড়ি, মোহনচূড়া অন্যতম। নির্জন বনের মধ্যেহাঁটার সময় নানারকম পাখির কিচির-মিচির ডাকে পাওয়া যায় অপার্থিব অনুভূতির স্বাদ।
এই উদ্যানের মূল বৃক্ষ শাল হলেও এখানে শনাক্ত করা হয়েছে ৫২টি পরিবার ও ১৪৭টি গোত্রের ৩৫৬ প্রজাতিরউদ্ভিদ।
এর মধ্যে জিগা, অর্জুন, আলই, মেহগনি, আকাশমনি, কড়ই, কাঠাল, আমলকি, হরিতকি, বহেরা ইত্যাদি বেশিপরিমাণে লক্ষ্য করা যায়।
বর্তমানের শালগাছগুলো রোপন করা হয়নি। এগুলো প্রাকৃতিকভাবে পূর্বের গাছগুলোর কপিচ থেকে উৎপন্ন।বর্তমানে নতুন করে শালগাছ রোপন না হওয়ার পেছনে রয়েছে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক বা এডিবি।
শাল বা গজারিকে তারা কম উৎপাদনশীল বিবেচনা করে এখানে ইউক্যালিপটাস ও এই ধরনের দ্রুত বর্ধনশীল বৃক্ষরোপনে অর্থায়ন করে আসছে।
কালের বিবর্তনে নানারকম প্রতিকূলতা আর অযত্ন-অবহেলায় জাতীয় উদ্যানের বৈচিত্র, রং-রুপ ধীরে ধীরে ফিকেহয়ে আসছে।
তবে সাম্প্রতিককালে বনবিভাগ হারানো ঐতিহ্য ফিরে আনতে নানাবিধ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পত্রিকায় প্রকাশিততথ্য অনুযায়ী, উদ্যানের বেদখল হয়ে যাওয়া ভূমি উদ্ধারের পাশাপাশি বিভিন্ন সময় নানারকম বন্যপ্রাণী অবমুক্ত করাহচ্ছে ও উদ্যানের বিভিন্ন জায়গায় বট, তমাল, আগরসহ বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ রোপন করে বনেরপরিবেশ ঠিক রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু তা যে প্রয়োজনীতার তুলনায় নিতান্তই সামান্য তা এই উদ্যান ভ্রমণেগেলেই টের পাওয়া যায়।
পর্যটন সুবিধা :–
ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য নানা ধরনের উদ্যেগ নানা সময়ে নেওয়া হয়েছে। উদ্যানেরভেতর রয়েছে বেশ কয়েকটি কটেজ ও বিশ্রামাগার। কটেজগুলোর নামও কিন্তু বাহারী। যেমন- শ্রান্তি, শাপলা,জেসমিন, চম্পা, মাধবী, জুই, চামেলী ইত্যাদি। রয়েছে ত্রিশটিরও বেশি পিকনিক স্পট। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী,প্রত্যেক বছর প্রায় সাড়ে তিন লাখ পর্যটক আসেন উদ্যানটিতে।
বনভোজনের জন্য পিকনিক স্পটগুলো ভাড়া নিতে রয়েছে নানারকম ট্যারিফ। কটেজগুলো ভাড়া নিতেও বিভিন্নধরনের ট্যারিফ রয়েছে।
তবে মনে রাখার বিষয় হচ্ছে, এখানে রাত্রি যাপনের অনুমতি প্রদান করা হয় না। তবে থাকার জন্য উদ্যানের সামান্যদূরত্বের মধ্যেই বেশ কয়েকটি ব্যক্তিমালিকানাধীন চমৎকার মানের হোটেল কিংবা রিসোর্ট অাছে। আছে সাধারণমানের অসংখ্য হোটেলও।
আর যেকোনো কটেজ কিংবা পিকনিক স্পট বুকিংয়ের ক্ষেত্রে বনবিভাগের মহাখালী কার্যালয় থেকে আগাম বুকিংকরতে হয়। তবে উদ্যানের সামান্য দূরেই অবস্থিত জাতীয় উদ্যান, রাজেন্দ্রপুর রেঞ্জ কার্যালয় থেকেও নির্ধারিত ফিজমা দিয়ে বুকিং নেওয়া যায়।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি উদ্যানের ভেতরে গড়ে তোলা হয়েছে
- মিনি চিড়িয়াখানা,
- সুউচ্চ পরিদর্শন টাওয়ার,
- প্রজাপতি বাগান, কচ্ছপ প্রজনন কেন্দ্র ও
- শিশুপার্ক
সহ নানা কৃত্রিম স্থাপনা। তবে সৌন্দর্যের সাথে কদর্য দিকগুলোও ভুলে যাওয়ার নয়। বিভিন্ন রকম অপরাধমূলককর্মকান্ডের জন্য গহীন জঙ্গলে যাওয়া থেকে নিরুৎসাহিত করে থাকে স্বয়ং উদ্যান কর্তৃপক্ষ নিজেই। কাজেইঘুরতে গেলে সতর্ক থাকার প্রয়োজন আছে বৈকি।
প্রতিবছর প্রায় ১৫,০০,০০০ দেশী-বিদেশী পর্যটক এখানে বেড়াতে আসেন।
বিঃ দ্রঃ অবশ্যই মনে রাখবেন
- ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান প্রতিদিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খোলা থাকে।
- ভ্রমণের সময়ে উদ্যানের ভেতরে মাইক, কিংবা উচ্চ শব্দ তৈরি করা কোনো যন্ত্র বাজানো নিষেধ।
- এছাড়া বন্যপ্রাণীরা বিরক্ত হয় এমন কোনো আচরণ করাও নিষেধ।
- বনের ভেতরে পাখি শিকার কিংবা লেকে মাছ ধরা দণ্ডনীয় অপরাধ।
- বনের ভেতরে কিছু এলাকা বেশ নির্জন। এসব যায়গায় যাওয়া বিপজ্জনক।
ছুটি কিংবা শহুরে কর্মব্যস্ততার যান্ত্রিক জীবনের মধ্যে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে কাটাতে পারেন দু’দন্ড প্রশান্তিময়সময়। হারিয়ে যেতে পারেন পাখিদের মনোলোভা সুরে, কিংবা হৃদয়-কাড়া শালবনের মোহনীয় রুপের মূর্ছনায়।
সময় নিয়ে ঘুরে আসুন এই সুন্দর ও উপভোগ্য জায়গাটি থেকে। শিশুদের সঙ্গে বড়দেরও ভালো লাগবে এইআয়োজন।