বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে কিছুটা গতি আনছে কোরবানি

কোরবানি

করোনা ও বন্যার কারণে বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে কিছুটা গতি নিয়ে আসছে কোরবানি। মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ছে।

বিশেষ করে দেশীয় পোশাক কারখানাগুলোয় উৎপাদন অনেক বেড়েছে। বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসায়ীদের চলছে চূড়ান্ত প্রস্তুতি। কোরবানির অর্থনীতির মূল চালিকা হচ্ছে গবাদি পশু বেচাকেনা। এবার দেশে ১ কোটি ১০ লাখ চাহিদার বিপরীতে কোরবানির পশু মজুদ রয়েছে ১ কোটি ১৯ লাখ। এ ছাড়া চামড়া, মসলা, দা, বঁটি, পরিবহন, পোশাকসহ বিভিন্ন খাতের উদ্যোক্তাদের ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। বাড়ছে টাকার প্রবাহও। মন্দার মধ্যেও বেড়েছে রেমিটেন্স (প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ)।

করোনার মধ্যেও সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের একটি অংশ বোনাস পেয়েছেন। সীমিত আকারে চলছে গণপরিবহন। সবকিছু মিলে দেশের অর্থনীতিতে কিছুটা গতি ফিরতে শুরু করেছে। তবে ২০টিরও বেশি জেলায় বন্যার কারণে এবারও উৎসবে ঘাটতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, প্রতিবছরই এই উৎসবে অর্থনীতিতে গতি বাড়ে। তবে এবার উল্লেখযোগ্য কিছু হবে বলে মনে হয় না। কারণ, অর্থনীতিতে অনেক রকম সমস্যা রয়েছে। বন্যার কারণে অনেক জায়গায় খাদ্য সংকট। এ কারণে কোরবানি দেয়ার লোক কম। তবে কিছুটা গতি বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।

করোনার কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা চলছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সর্বশেষ তথ্যানুসারে বিশ্বের মোট জিডিপির আকার ৮৮ ট্রিলিয়ন ডলার। কিন্তু করোনার কারণে তা ৩ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার কমবে, যা মোট জিডিপির ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। আর করোনার কারণে গত ৩০ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ক্ষতি ৯-২১ বিলিয়ন ডলার। বিভিন্ন হিসাব অনুসারে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ১ কোটি ৬০ লাখ থেকে ৪ কোটি ২০ লাখ মানুষ। আর করোনার আগের সংখ্যা মিলিয়ে দরিদ্র ও ভঙ্গুর জনশক্তির সংখ্যা দাঁড়াবে ৭ কোটি, যা দেশের মোট জনশক্তির ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর দেশের ২০টির বেশি জেলা বন্যাকবলিত। সবকিছু মিলিয়ে অর্থনীতিতে বিপর্যস্ত অবস্থা। এ অবস্থায় কোরবানির কারণে কিছুটা গতি আসতে পারে অর্থনীতিতে।

জানা গেছে, আগামী ১ আগস্ট দেশে ঈদুল আজহা উদ্যাপিত হবে। এ হিসাবে মাত্র ৬ দিন বাকি। কোরবানিতে পশু জবাইকে কেন্দ্র করেই উদ্যাপিত হয় মূল উৎসব। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে বর্তমানে দেশে গবাদি পশুর সংখ্যা ৫ কোটি ১০ লাখ। এর মধ্যে গরু ও মহিষ দুই কোটি ৩৫ লাখ এবং ছাগল ও ভেড়া দুই কোটি ৫৫ লাখ। এ বছর কোরবানির উপযোগী এক কোটি ১৮ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০টি পশু রয়েছে। এর মধ্যে ৪৫ লাখ ৩৮ হাজার গরু ও মহিষ এবং ৭৩ লাখ ৫৫ হাজার ছাগল ও ভেড়া। অন্যান্য সাড়ে ৪ হাজার। কোরবানিতে চাহিদা ১ কোটি ১০ লাখ। গত বছর কোরবানি হয়েছিল ১ কোটি ১২ লাখ পশু। তবে এবার পশুর চাহিদা সংখ্যা কমবে। কারণ, এবার কোরবানির সক্ষমতা কম।

এদিকে পশু কোরবানির সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতিতে চামড়ার ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। ব্যবসায়ীদের মতে, প্রতিবছর দেশে দেড় কোটিরও বেশি পশুর চামড়া পাওয়া যায়। এর বড় অংশই আসে কোরবানির পশু থেকে। চামড়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখাতের মূল বাজার ৪-৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত অন্যান্য বাজারসহ এ খাতে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। এ বছর কোরবানির চামড়া কিনতে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে কয়েকটি ব্যাংক। জানা গেছে, প্রতিবছর দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২২ লাখ টন। রসুনের চাহিদা ৫ লাখ টন, আদা ৩ লাখ টন। এর উল্লেখযোগ্য অংশই কোরবানিতে ব্যবহার হয়। অন্যদিকে গরম মসলা, বিশেষ করে এলাচি, দারুচিনি, লবঙ্গ, জিরা, তেজপাতার উল্লেখযোগ্য অংশ কোরবানিতে ব্যবহার হয়। কোরবানির বাজারে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হবে এসব পণ্যের। কোরবানির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হল কামার আইটেম। ছুরি, বঁটি, দা, চাপাতি, কুড়াল, রামদা ছাড়া কোরবানিই সম্ভব নয়। সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কোরবানিতে পণ্যটির বাজার এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

অন্যদিকে বাজারে বাড়ছে টাকার প্রবাহ। মন্দার মধ্যেও গত জুনে প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন ১৮২ কোটি ডলার। প্রতি ডলার ৮৫ টাকা হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় যা ১৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, এ বছর রেমিটেন্সপ্রবাহ কিছুটা বাড়ছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের এক সমীক্ষায় বলা হয়, ঈদে পরিবহন খাতে অতিরিক্ত যাচ্ছে ৬০০ কোটি টাকা। এই উৎসবে ভ্রমণ ও বিনোদন বাবদ ব্যয় হয় ৪ হাজার কোটি টাকা। এসব খাতে নিয়মিত প্রবাহের বাইরে অতিরিক্ত যোগ হচ্ছে এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে আরও কয়েকটি খাতের কর্মকাণ্ড অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ২১ লাখ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সম্ভাব্য বোনাস বাবদ ১২ হাজার কোটি টাকা। দেশব্যাপী ৬০ লাখ দোকান কর্মচারী, পোশাক ও বস্ত্র খাতের ৭০ লাখ শ্রমিকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশই ঈদে কিছুটা বোনাস পাবে, যা ঈদ অর্থনীতিতে বাড়তি গতি আনছে।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.