দেশব্যাপী ৬৬ দিন লকডাউনের পর মহানগরজুড়ে ২০ মিলিয়ন মানুষের অর্থনৈতিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু হওয়ার পর, গ্রাহকের সংখ্যা ও চাহিদা কমে গেছে। আগে কোনোকিছু পছন্দ হলেই মানুষ তার সাধ্যানুযায়ী কিনলেও বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন। এখন মানুষ অতিপ্রয়োজনী পণ্য ছাড়া আর কিছু কিনছে না। স্বাস্থ্য পণ্য, মুদি এবং নিত্যদরকারি কিছু আইটেম ছাড়া রাজধানীর অন্যান্য ব্যবসাগুলো ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়েছে। বেশিরভাগ ব্যবসায় বিক্রি কমেছে প্রায় ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ।
বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকারি চাকরি ব্যতীত অন্য সব ক্ষেত্রেই বেতন কাটা ও ছাঁটাইয়ের প্রাথমিক প্রভাব পড়েছে স্থানীয় মার্কেটে। ফলে রাজধানীকেন্দ্রিক এসব ব্যবসার উপর নির্ভরশীল মানুষগুলোও কঠিন সময় কাটাচ্ছে। আপতকালীন অর্থনৈতিক সংকট ছাড়াও ক্রেতাদের বড় একটা অংশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির জন্য মার্কেট আসছেন না।
রাজধানীর পল্টন গার্লস স্কুল রোডের একটি ছোট রেস্তোরাঁর মালিক রাসেল। ৮০ দিনের বিরতি শেষে গত সপ্তাহে তা খোলার পর যে টাকা বিক্রি হয়েছে তা দিয়ে কর্মচারীদের পাওনাই মিটবে না বলে জানান রাসেল। তিনি বলেন, আগে দিন শেষে ১৪-১৫ হাজার আয় হতো। কর্মীদের বেতন দেয়ার পর বেশ ভালো লাভ থাকত। তবে এখন দিনের শেষে যদি ১০০০ টাকা থাকে তাহলেই নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়।
রাসেল ও আবদুলস্নাহর মতো বড় বড় দোকান, কর্পোরেট শোরুম এবং বিভিন্ন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা একইভাবে হ্রাস পেয়েছে।
বাংলাদেশ শপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেছেন, কোভিড-১৯-এর প্রতিকার না পেয়ে এমনিতেই মানুষ খুব চিন্তিত। জীবন বাঁচাতে প্রতিদিনের প্রয়োজনের বাইরে কোনো কিছু না কেনাই গ্রাহককে নিরুৎসাহিত করার পক্ষে যথেষ্ট। প্রায় ৮০% দোকানের দরজা খোলা তবে গ্রাহকের উপস্থিতি খুব কম। বিক্রি না থাকার ফলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখাই দায়।
হেলাল উদ্দিন অনুমান করেছেন যে, দেশজুড়ে প্রায় ৩০ লাখ দোকানের মধ্যে বেশিরভাগই তাদের ব্যয়ের অর্থই উপার্জন করতে পারছে না। যা নিশ্চিতভাবে এক কোটি মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করছে। হেলাল উদ্দিনের মতে চাহিদা হ্রাস পাওয়ার দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমটি হলো মহামারি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা এবং দ্বিতীয় কারণটি ভীতিজনক। তা হলো মানুষের আয় কমে যাওয়া।
দিনমজুরসহ নিম্নআয়ের অধিকাংশই শহর ছেড়ে চলে গেছে। পরিবহণ সেক্টর হাজার হাজার শ্রমিক এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের শ্রমিকরা প্রতিদিনের মজুরির জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন। রাইড শেয়ারিং মাধ্যমে জীবিকা উপার্জনকারীদের বেশ বড় একটা অংশ বেকার হওয়ায় ইতোমধ্যে তারা রাজধানী ত্যাগ করেছেন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, একজনের ব্যয় অন্যজনের জন্য আয়। আয় হারানো বা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য লোকেরা তাদের অর্থ ধরে রাখে যার ফলস্বরূপ কর্পোরেট উৎপাদনকারী বা সাধারণ ব্যবসায়ী সবাই খারাপ সময় পার করছে।
কর্পোরেট চাহিদার পতনের ফলে তারা বেতন কাটাসহ কর্মীদের ছাঁটাই করছেন। ব্যয় কমানোর মাধ্যমে চ্যালেঞ্জগুলোর সাথে লড়াই করার চেষ্টা করছেন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এমনকি অর্থনীতির চালিকাশক্তির উৎস ব্যাংকগুলোতেও কর্মীদের বেতন কমানোসহ ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটছে।
পর্যটন ও আতিথেয়তা, রেস্তোরাঁ, চিকিৎসা এবং শিক্ষা সম্পর্কিত ব্যবসায়িক খাতগুলো মহমারিটির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জুনের প্রথম সপ্তাহে মিরপুরের রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন তার ৪টা রেস্তোরাঁ খুলেছিলেন। তবে বিক্রি কম হওয়ায় তাকে তিনটিই বন্ধ করে দিতে হয়েছিল।
বাংলাদেশ হোটেল-রেস্তোরাঁ ও সুইটমিট ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল আনোয়ার হোসেন বলেছেন, করোনাভাইরাস ভয় এবং আর্থিক সংকট উভয়ই কম বিক্রির প্রধান কারণ। লোকসানের কারণে বড় বড় রেস্তোরাঁগুলো আবার চালু হচ্ছে না ফলে কয়েক হাজার শ্রমিক কোনো আয় ছাড়াই রয়েছেন।
তিনি বলেন, ১০% মাঝারি বা বড় রেস্তোরাঁ খোলা হয়েছে শপিংমল এবং বাজারগুলো সেফটি প্রটেকশনসহ তাদের দরজা খুলেছে, তবে বিক্রি ৭০%-৯০% হ্রাস পেয়েছে।
বাংলাদেশ ফার্নিচার ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সেলিম এইচ রহমান জানান, ইদ-উল-ফিতরের আগে মাত্র ১২-১৫% ফার্নিচার বিক্রি হয়েছিল। এখন এটি ১০%-এরও কম। বেশিরভাগ মানুষের আয় কমে যাওয়ায় নতুন আসবাবপত্র কেনার পরিস্থিতিতে তারা নেই। যারা কিনছে একান্ত বাধ্য হয়েই কিনছে।
রাজধানীর বিভিন্ন শপিংমলের কসমেটিকস বিক্রেতারা তাদের বিক্রয় ৯০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে বলে জানিয়েছেন। অনেকেই ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার চিন্তাও করছেন।
এদিকে কারওয়ান বাজারের পাইকাররা জানান, মুদি পণ্যের বিক্রয়ও নিম্নমুখী। কারওয়ান বাজারের পাইকারি বাজারের চাঁদপুর স্টোরের মালিক রফিকুল ইসলাম বলেন, এই মহামারিকালীন সময়ে বিবাহ বা পারিবারিক জমায়েতের মতো সামাজিক অনুষ্ঠান নেই, লোকেরা আগের মতো মুদি জিনিস কিনে না।
মুদি দোকানের জন্য রেস্তোরাঁগুলোর অর্ডার কমে গেছে এবং তার বিক্রয় এক-তৃতীয়াংশ কমেছে। তিনি অনুমান করেন যে তার নিয়মিত গ্রাহকদের ২০%-২৫% এখন শহরে নেই।
মহানগরে মেঘনা গ্রম্নপ, তেল, চিনি ও ময়দার মতো প্রয়োজনীয় পণ্যগুলো বড় একটা অংশ সরবরাহ করে। তবে লকডাউনের পরে এসব পণ্যের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে বলে দাবি করেছে মেঘনা গ্রম্নপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের কর্মকর্তারা। তারা জানান, এসব পণ্যর চাহিদা ৩০% কমে ৪০%-এ নেমেছে। বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুযায়ী ইস্পাত বিক্রয় কমেছে এক-চতুর্থাংশ।