প্রাচীন এক ধর্মীয় হিব্রু পাণ্ডুলিপি ঘিরে দীর্ঘদীনের এক বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছেন বাংলাদেশি গবেষক মারুফ ঢালি। এতদিন ধরে ভাবা হতো যে, পাণ্ডুলিপিটি কেবল একজনই লিখেছেন। কিন্তু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে পাণ্ডুলিপির লেখাগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঢালি দেখিয়েছেন যে, আদতে দেখতে একইরকম হলেও পাণ্ডুলিপিটি লিখেছেন দু’জন ব্যক্তি।
ঢালি যে পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে কাজ করেছেন সেটি একটি বিখ্যাত ‘ডেড সি স্ক্রল’— পশ্চিম তীরে মৃত সাগরের উত্তর তীরে এইন ফ্রেশকার নিকটে জুডিয়ান মরুভূমির কামরান গুহা এবং ইসরাইলের ‘কেভ অব হরর’-এ পাওয়া প্রাচীন ইহুদি ও হিব্রু ধর্মীয় পাণ্ডুলিপি। এসব স্ক্রলের সংখ্যা প্রায় এক হাজার। হিব্রু বাইবেলের সবচেয়ে প্রাচীনতম পাণ্ডুলিপি এগুলো। এর মধ্যে কোনো কোনোটির বয়স খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টাব্দ দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত। কারা বা কতজন ব্যক্তি এসব পাণ্ডুলিপি লিখেছেন তা এখনো অজানা। তবে ঢালি ও তার সহকর্মীদের নতুন আবিষ্কার সে রহস্য উন্মোচনে নতুন সম্ভাবনা গড়ে তুলেছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত লাইভসাইন্সের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ঢালি ও তার সহকর্মীরা যে পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে কাজ করেছেন তার নাম ‘ইসাইয়াহ স্ক্রল’। লম্বায় এটি প্রায় সাত মিটার দীর্ঘ। প্রায় ৭০ বছর আগে জেরুজালেমের কাছে কামরান গুহায় একটি বয়ামের ভেতর এক আরব বেদুইন এটি খুঁজে পান। নেদারল্যান্ডসের গ্রুনিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই গবেষকের—ম্লাদেন পপোভিচ ও ল্যাম্বার্ট শমেকার— সঙ্গে মিলে স্ক্রলটির নতুন রহস্য উন্মোচন করেছেন ঢালি। বিশ্ববিদ্যালয়টির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিভাগে কম্পিউটার-ভিত্তিক ইমেজ প্রসেসিং ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে পিএইচডি গবেষণা করছেন ঢালি।
গবেষণা প্রতিবেদনে লেখা হয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে দেখা গেছে যে, ডেড সি স্ক্রলটি একজন নয়, দু’জন লিখেছেন। কিন্তু তাদের লেখা খালি চোখে দেখতে একইরকম লাগে। এ থেকে ধারণা করা হচ্ছে যে, হয়তো দু’জন লেখক একইরকম প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন।
গবেষণাটির প্রধান গবেষক ম্লাদেন পপোভিচ। তিনি গ্রুনিগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হিব্রু বাইবেল ও প্রাচীন ইহুদিবাদ বিষয়ক অধ্যাপক।
তিনি লাইভসায়েন্সকে বলেন, আমরা প্রত্যেকটি স্ক্রল মাইক্রো পর্যায়ে বিশ্লেষণ করার দুয়ার উন্মোচন করেছি। সবগুলো ডেড সি স্ক্রল নতুন করে গবেষণার সুযোগ তৈরি করেছি। এ থেকে আমরা কী ধরণের পাণ্ডুলিপি নিয়ে কাজ করছি সে সম্পর্কে নতুন ধারণা পেতে পারি।
তেল আবিব ইউনিভার্সিটির ফলিত গণিত বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রাচীন হাতের লেখা বিশেষজ্ঞ শিয়া ফাইগেনবম জানান, এই প্রথম ইসাইয়াহ স্ক্রলের লেখার ধরণ শনাক্তে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে।
যেভাবে রহস্য উন্মোচন করলেন ঢালি
ইসাইয়াহ স্ক্রলের লেখক সংখ্যা নিয়ে বেশ আগে থেকেই বিতর্ক রয়েছে। অনেক গবেষকই দাবি করেছিলেন পাণ্ডুলিপিটি দু’জন লিখেছেন। সে দাবির পক্ষেই প্রমাণ জোগাড় করেছেন ঢালি। এ জন্য ‘বাইনারাইজেশন’ নামে পরিচিত নতুন একটি এলগিরদম তৈরি করেন তিনি। এলগরিদমটি ডিজাইন করার সময় সেটিকে প্রাণীর চামড়া বা প্যাপিরাসের কালির লেখায় পার্থক্য ধরতে শেখানো হয়। এই এলগরিদম ব্যবহার করে পাণ্ডুলিপিটির লেখার মধ্যে সূক্ষ্ম তারতম্য শনাক্ত করা গেছে যা খালি চোখে ধরা পড়ে না।
ঢালি এমন একটি কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক তৈরি করেন যেটিকে ‘ডিপ লার্নিং’ পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রশিক্ষিত করে তোলা যাবে। এই নিউরাল নেটওয়ার্ক পাণ্ডুলিপিতে মূল কালির চিহ্নগুলো রেকর্ড করার পর সেগুলোকে ডিজিটাল ছবিতে রূপ দেওয়া হয়।
গ্রুনিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ক অধ্যাপক ল্যাম্বার্ট শমেকার বলেন, এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ, কেননা প্রাচীন কালির চিহ্ন একজন ব্যক্তির পেশির-গতিবিধি সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করতে পারে।
নিউরাল নেটওয়ার্কটির বিশ্লেষণে বেরিয়ে এসেছে যে, ইসাইয়াহ স্ক্রলের ৫৪টি কলামের মধ্যে এমন কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে যার ভিত্তিতে কলামগুলোকে দুইটি দলে বিভক্ত করা যায়। এই বিশ্লেষণের পর ঢালি ধারণা করেন, পাণ্ডুলিপিটি হয়তো একাধিক ব্যক্তি লিখেছেন। তার ধারণার উপর ভিত্তি করে শোমেকার নিজেও আলাদাভাবে লেখাগুলো বিশ্লেষণ করেন। তাতেও একই ফল আসে। পরবর্তীতে আরো কিছু পরীক্ষা-নীরিক্ষা শেষে তারা জানান, বিশ্লেষণ করা ৫৪টি কলামের মধ্যে ২৭টি লিখেছেন একজন ব্যক্তি ও বাকি ২৭টি লিখেছেন আরেকজন।