বাঘের আবাসস্থল, অবৈধ শিকার ও বাঘ সংরক্ষণের হুমকি কমিয়ে আনায় মানুষ ও বাঘের দ্বন্দ্ব কমেছে। অত্যাধুনিক ডিভাইস ও আধুনিক জলযানসমৃদ্ধ স্মার্ট পেট্রোলিং বেড়েছে। ফলে বাঘ, হরিণসহ বন্যপ্রাণী পাচার, শিকার, চোরাচালান রোধ, বনজসম্পদ ধ্বংস ও অবৈধভাবে বনে প্রবেশ কমেছে। জীববৈচিত্রের পরিমাণ ও কুমিরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। হাকালুকি হাওড়ে পাখির সংখ্যা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়নের ফলে ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়নের ফলে দর্শনার্থীদের সংখ্যাও বেড়েছে। ‘স্ট্রেংদেনিং রিজিওনাল কো-অপারেশন ফর ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশন’ শীর্ষক সমাপ্ত প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এমনই চিত্র পাওয়া গেছে।
সাড়ে পাঁচ বছরে বাস্তবায়ন করা প্রকল্পটি কতটুকু সফল হয়েছে তা জানতেই বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) থেকে এই প্রভাব মূল্যায়ন করা হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে বন অধিদপ্তর।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশে প্রতিকুল পরিবেশ, বন্যপ্রাণী হত্যা ও সংরক্ষণজনিত অবহেলার কারণে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। বন বিভাগে দক্ষ জনবল, উপযুক্ত পরিবীক্ষণব্যবস্থা, অবকাঠামো ও বাজেট স্বল্পতার কারণে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না।
এ জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পটি তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশনে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হলে সার্বিক দিক বিবেচনা করে একনেক সভায় ২০১১ সালের ২১ জুলাই অনুমোদন দেয়া হয়। পাঁচ বছরে বাস্তবায়নের জন্য তাতে ব্যয় ধরা হয় ২৭৬ কোটি টাকা।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিলো— ওয়াইল্ড লাইফ সার্কেলকে কার্যকর করে বন্যপ্রাণীর অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করা, বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রশিক্ষণ, গবেষণা, সচেতনতা ও পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা।
অংশগ্রহণকারী দেশের সংরক্ষিত এলাকা ব্যবস্থাপনা ও অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা বিনিময়ের মাধ্যমে বন্যপ্রাণীর সাথে সম্পৃক্ত স্থানীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করা।
এছাড়া প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ইউনিটের মাধ্যমে ওয়াইল্ড লাইফ সার্কেলের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আঞ্চলিক সমন্বয় ও যোগাযোগের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
আইএমইডি শহিদুল কনসালটেন্ট পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গত ফেব্রুয়ারিতে তথ্য সংগ্রহ করে এপ্রিলে খসড়া তৈরি করা হয়। তারপর কর্মশালার আয়োজন করে সংশ্লিষ্টদের মতামত নেয়ার পরই গত জুনে এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি ৬৪ জেলার ৪৬৫টি উপজেলা ধরা হলেও বেশিরভাগ কার্যক্রম ৩৫টি সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও সম্ভাবনাময় সংরক্ষিত এলাকায় বাস্তবায়িত হয়েছে। এরমধ্যে জাতীয় উদ্যানে ১৪টি, বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ১২টি, সাফারি পার্কে ২টি, হাকালুকি হাওড়ে বিশেষ জৈব-বৈচিত্র্য সংরক্ষিত এলাকায় ১টি, কক্সবাজারের বৈসারির বিশেষ জৈব-বৈচিত্র্য সংরক্ষিত এলাকায় ২টি, বোটানিকাল গার্ডেনে ৩টি, মহেশখালী-সোনাদিয়ার সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকায় ১টি স্থান নির্ধারণ করা হয়।
সংশোধন করে বিভিন্ন কাজ বাস্তবায়নে মোট ২৬৮ কোটি টাকা ব্যয় করার অনুমতি দেয় সরকার। তাতে প্রকৃত ব্যয় হয়েছে ২২৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে বেতনভাতাদি পরামর্শক নিয়োগ, সরবরাহ ও সার্ভিসেস খাতে বরাদ্দকৃত ১৩২ কোটি টাকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ১১৯ কোটি টাকা বা ৫২ শতাংশ ব্যয় হয়েছে।
ওয়াইল্ডলাইফ সেন্টার নির্মাণসহ অবকাঠামো ও পূর্তকাজে ৮৩ কোটি টাকার মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৮০ কোটি টাকা বা ৩৫ শতাংশ। ১টি জিপ গাড়ি, ১টি মাইক্রোবাস, ৪টি পিক-আপ, ৫০টি মটরসাইকেল, ৯টি স্পিডবোটসহ অন্যান্য যানবহন, অফিস, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কেনায় প্রায় ২১ কোটি টাকার মধ্যে ২০ কোটি টাকা বা ৯ শতাংশ ব্যয় হয়েছে।
যা প্রকল্প শেষে বন বিভাগে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ বাবদ বরাদ্দকৃত অর্থের ৬ কোটি ২২ লাখ টাকার মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে ১৩১৯ জন ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ১০৪ জন কর্মকর্তার প্রশিক্ষণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬ কোটি টাকা বা ২ দশমিক ৬১ শতাংশ। কিন্তু তারা সামাজিক বন বিভাগে নিয়োগ পাওয়ায় প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনায় কাজে লাগাতে পারেনি।
৪৭৮ হেক্টর বা সাড়ে ৩ হাজার বিঘা জমি বনায়নে বরাদ্দের পুরোটাই প্রায় ৫৮ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। তবে প্রকল্পের আওতায় কেনাকাটায় পিপিএ ২০০৬ এবং পিপিআর ২০০৮ লঙ্ঘন করা হয়েছে। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিধি অনুসরণ করেনি।
ক্রয়সংক্রান্ত সব ফাইল কেবিনেটে তালাবদ্ধ আছে বলে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দেখানো হয়নি। ২০১১ সালের জুলাই থেকে ৬ মাস সময় বাড়িয়ে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে বাস্তবায়ন করা হয় প্রকল্পটি।
ড. তপন কুমার দে, অপরুপ চৌধুরী, মো. আকবর হোসেন ও আব্দুল মাবুদ প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ৩ মাস পর পর প্রকল্প বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির (পিআইসি) সভা হওয়ার কথা থাকলেও পুরো সময়ে মাত্র ৩ বার সভা অনুষ্ঠিত হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অত্যাধুনিক ডিভাইস ও আধুনিক জলযানসমৃদ্ধ পেট্রোলিংয়ের কারণে আগের চেয়ে আসামি গ্রেপ্তার, নৌকা, ট্রলার জব্দ বেড়েছে। ফলে অবৈধভাবে পাচারের সাথে জড়িত বনদস্যুরা ধরা পড়ছে। সুন্দরী কাঠ, কুমির, হরিণ ও বাঘ পাচার রোধ করা যাচ্ছে।
শুধু তাই নয়, হাতির খাদ্য উপযোগী বাগান তৈরির ফলে স্থানীয় জনগণের সাথে দ্বন্দ্বের পরিমাণ আগের তুলনায় অনেক কমেছে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বিঘা জমিতে বনায়ন করা হয়েছে।
এরমধ্যে পাখির জন্য ৩০০ হেক্টর জলাভূমি বনায়ন করা হয়েছে। ফলে হাকালুকি হাওরে পাখির সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে পশুপাখির খাদ্য সংকট অনেকটা দূরীভূত হয়েছে।
এতে দর্শনার্থীদের সংখ্যাও আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। শকুনের জন্য খুলনা ও সিলেটের ৪৭ হেক্টর নিরাপদ এলাকা ঘোষণা করায় নিরাপদ আবাসস্থল নিশ্চিত হয়েছে।
শুধু তাই নয়, প্রকল্পের আওতায় বাঘের আবাসস্থল, অবৈধ শিকার ও বাঘ সংরক্ষণের হুমকি কমিয়ে বাঘের সংখ্যা বাড়াতে কো-ম্যানেজমেন্ট কমিটি, টাইগার রেসপন্স টিম ও ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম গঠন, বন নির্ভরশীলতা কমানোর উদ্যোগ গ্রহণের ফলে মানুষ ও বাঘের মধ্যে দ্বন্দ্বে কমেছে।
বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ক্যামেরা ট্রাপিং পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে ডোরাকাটা ছাপের বিশ্লেষণ করে প্রতিটি বাঘকে পৃথক করা যায়। ফলে বাঘের সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে।
এ পদ্ধতিতে ২০১৫ সালে সুন্দরবনে ১০৬টি বাঘ পাওয়া গেছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে ১১৪টি বাঘ পাওয়া গেছে। বন্যপ্রাণীর লাল তালিকা হালনাগাদ করার ফলে দেশে কোন প্রজাতি কি অবস্থায় আছে সে সম্পর্কে ধারণা তৈরি এবং প্রজাতিগুলো সংরক্ষণে পেশাদারী সক্ষমতা তৈরি হয়েছে।