দিন দিন নদীতে নৌ দুর্ঘটনায় লাশের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। মৃত্যুবরণ ছাড়াও অনেকেই পঙ্গু হয়ে গেছেন সারাজীবনের জন্য। অতিরিক্ত যাত্রী তোলা, ঘাটে লঞ্চ ভিড়াতে নিজেদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি, আবার বের হওয়ার সময়ও চলে প্রতিযোগিতা।
ঘাটের স্থান দখলে লঞ্চের প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে ইতোমধ্যে নিহত হয়েছেন অনেকেই। তাদের এমন প্রতিযোগিতার কারণে লঞ্চগুলোর মধ্যে ধাক্কাধাক্কি ও সংঘর্ষের ঘটনায় রক্তাক্ত হচ্ছেন যাত্রীরা। নৌবন্দরে বিশৃঙ্খলা চলছে লঞ্চ মালিক-কর্মচারীদের মধ্যে।
গত ২৯ জুন সকালের দিনের আলোয় ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে সংঘটিত নৌ দুর্ঘটনায় স্তম্ভিত সারা দেশের মানুষ। নদী বিস্মৃত বরিশালের নৌপথের নিয়মিত যাত্রীরাও সামপ্রতিক সময়ের ধারাবাহিক দুর্ঘটনার ঘটনায় ভীত। নৌপথে চলাচলে নিরাপত্তাহীনতা তাড়া করে বেড়াচ্ছে প্রতিদিন হাজারো যাত্রীকে। তাদের মতে, অদক্ষ চালক দিয়ে নৌযান পরিচালনা, ফিটনেসহীন নৌযান দিয়ে পরিবহন ও নৌপথে শৃঙ্খলা না থাকায় এমন দুর্ঘটনা ঘটছে অহরহ। অন্যদিকে দুর্ঘটনার কবলে পড়া নৌযানগুলো উদ্ধারে কর্তৃপক্ষের কারিগরি দুর্বলতাও এসেছে প্রকাশ্যে। অদক্ষচালক দিয়ে নৌযান পরিচালনার দায় লঞ্চ মালিকদের ওপর চাপাচ্ছেন নৌ কর্তৃপক্ষ।
তবে লঞ্চ পরিচালনার সঙ্গে জড়িত মানুষদের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ যাত্রীরা কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাবকে সামনে এনেছেন নৌ দুর্ঘটনার গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটি) বরিশাল অফিস থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেছে আতঙ্কিত হওয়ার মতো নানা চিত্র।
তাদের মতে, বরিশাল নদী বন্দর থেকে বিভিন্ন জেলা উপজেলার অভ্যন্তরীণ ১১টি ও দূরপাল্লার ১টি রুটে স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন প্রায় শতাধিক নৌযান (মাঝারি ও বৃহৎ) যাত্রী পরিবহন করে। এসব নৌযান দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ডুবে গেলে সেগুলো উদ্ধারে ৬০ মেট্রিকটন উত্তোলন ক্ষমতাসম্পন্ন ২টি ও ২৫০ মেট্রিকটন উত্তোলন ক্ষমতাসম্পন্ন আরও ২টি উদ্ধারকারী জাহাজ তাদের সংগ্রহে আছে।
কিন্তু বর্তমানে মাঝারি একটি নৌযানের ওজন ৩০০ মেট্রিকটনের বেশি। এছাড়া ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলে যাত্রী পরিবহন করা বিলাসবহুল নৌযানগুলোর স্বাভাবিক ওজন ১০০০ মেট্রিকটনের কম নয়। যে কারণে দুর্ঘটনায় পর্যবসিত হওয়া সাধারণ নৌযান (লঞ্চ অথবা জাহাজ) উদ্ধারে বেগ পেতে হয় তাদের।
ঢাকা নদী বন্দরে ভীড় করা একাধিক যাত্রী সাধারণের সঙ্গে কথা হয়। এসময় তারা অভিযোগের সুরে বলেন, অভ্যন্তরীণ রুটের বেশিরভাগ লঞ্চে আপদকালীন সময়ে জীবন বাঁচানোর পর্যাপ্ত উপকরণ থাকে না। এর ওপর লঞ্চ পরিচালনাকারীর (সারেং ও সুকানি) বেশিরভাগই অদক্ষ। এরই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ রুটের অনেক লঞ্চের ফিটনেস ঠিক নেই বলেও জানান তারা।
এসকল যাত্রীরা অভিযোগ করেন নৌ কর্তৃপক্ষ ঠিকমতো তদারকি করছে না বলেই এমন বিপদজনক অবস্থা বিরাজ করছে এ অঞ্চলের নৌপথগুলোতে। অন্যদিকে অদক্ষ চালকদের দিয়ে লঞ্চ পরিচালনা করার অভিযোগ উঠেছে খোদ চালকদের (সারেং) মধ্য থেকেই। সদর ঘাট লঞ্চ টার্মিনালে গিয়ে কথা হয় অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার রুটের একজন লঞ্চ চালকের সঙ্গে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক চালক বলেন, লঞ্চ মালিকরা কম বেতনে অদক্ষ চালক নিয়োগ করে থাকে লঞ্চ পরিচালনার জন্য। যাদের বেশিরভাগেরই লঞ্চ চালনার প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা ব্যবহারিক জ্ঞান কম।
অনেকে সুকানিকে (লঞ্চের সাধারণ কর্মচারী) সারেং (চালক) হিসেবে কাজ করায়। অভ্যন্তরীণ রুটে প্রায় ত্রিশ বছর ধরে লঞ্চ পরিচালনা করা একজন সারেং (চালক) বলেন, আমাকে দিয়ে একদিন লঞ্চ চালাতে মালিকের কয়েক হাজার টাকা প্রয়োজন।
সেখানে অদক্ষ একজনকে দিয়ে লঞ্চ চালাতে পাঁচশ টাকার বেশি দরকার পড়ে না। খরচ কমানোর জন্য মালিকরা এ সুযোগ নেয়। যে কারণে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। তবে মালিকদের সঙ্গে সঙ্গে নৌ কর্তৃপক্ষকেও দূষলেন একজন চালক।
তিনি উল্লেখ করেন, কর্তৃপক্ষ যদি যথাযথ তদারকি করতো তবে অদক্ষ চালক দিয়ে লঞ্চ পরিচালনা করার ঘটনা বন্ধ করা যেতো। অদক্ষ চালক দিয়ে নৌযান পরিচালনা করার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলো নৌ কর্তৃপক্ষের কথাতেও।
ময়ূরী-২ লঞ্চের ড্রাইভার শিপর হাওলাদার বলেন, মালিক দায়ী এই লঞ্চ দুর্ঘটনার জন্য। তিনি কীভাবে অদক্ষ চালক দিয়ে লঞ্চ পরিচালনা করেন। ছুটি আছি। তাই কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটেছে। তা বলতে পারবো না। মালিকের ইচ্ছ মতই লঞ্চ পরিচালিত হয়। এ সময় অন্য ড্রাইভার নিলে খরচ বেশি হবে বলেই হেলপার দিয়ে লঞ্চে পরিচালনা করছেন।
বরিশাল নদী বন্দর (বিআইডব্লিউটিএ) কর্মকর্তা আজমল হুদা মিঠু বলেন, প্রতিটি লঞ্চ ছাড়ার আগে আমাদের পক্ষ থেকে লঞ্চের চালকসহ নিরাপত্তার অন্যান্য বিষয়ে তদারকি করা হয়। তবে কিছু কিছু সময় অভ্যন্তরীণ রুটের নৌযান মালিকেরা আমাদের চোখ এড়িয়ে সুকানি অথবা অদক্ষ চালক দিয়ে নৌযান পরিচালনার চেষ্টা করে থাকে।
দুর্ঘটনায়কবলিত লঞ্চকে উদ্ধার করার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তিনি বলেন, বর্তমানে উদ্ধারকারী জাহাজের চেয়ে এয়ার লিফটিং (বাতাস প্রতিসরণ) পদ্ধতি অবলম্বন করে ডুবন্ত বা ডুবতে থাকা নৌযান উদ্ধার করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ পদ্ধতি আরও কার্যকর করা গেলে উদ্ধারকারী জাহাজের ওপর ভরসা কমবে।
এদিকে, এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ চেয়ে সাধারণ জনগণের পাশাপাশি নৌপথগুলোয় সুরক্ষা বৃদ্ধির জোর দাবি এসেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বরিশাল অঞ্চলের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকেও। তারা নৌপথে দুর্ঘটনার নানা কারণ উল্লেখ করে সেগুলো সমাধানের পথ বাতলে দেয়ারও চেষ্টা করেছেন।
বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি অ্যাড. গোলাম আব্বাস চৌধুরী দুলাল নৌযান যাত্রীদের অনিরাপত্তার পেছনে নৌপথে বিশৃঙ্খলা ও অদক্ষ চালক দিয়ে নৌযান পরিচালনাকে দায়ী করেন। তিনি লঞ্চ মালিকদের প্রতি আহ্বান জানান যেন সকল নৌযানে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ চালক (মাস্টার) নিযুক্ত করা হয়। এছাড়া তিনি নৌপথে নৌ-পুলিশের টহল বৃদ্ধি করার কথাও বলেন।
তিনি বলেন, লঞ্চসমূহের ওভারটেকিং মনোভাব, নৌ ট্রাফিকিং সংকট ও নৌপথে মাছ ধরা ও ক্ষুদ্র নৌযানের আধিক্য কখনো কখনো বড় দুর্ঘটনা সৃষ্টি করে। যে কারণে নৌপথে শৃঙ্খলা রক্ষার্থে নৌ-পুলিশ প্রশাসনের আরও সজাগ হওয়া উচিত।
বরিশাল (দক্ষিণ) জেলা বিএনপির সভাপতি এবায়দুল হক চাঁন বলেন, নদী শাসন ও নৌ-পথগুলোতে শৃঙ্খলা আনয়নের জন্য সরকারি নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়ন ও প্রচলিত নীতিমালার আধুনিকায়ন জরুরি।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, নৌযান দুর্ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের যথাযথ বিচার আমরা দেখতে পারি না। এদের বিচার করা গেলে বেপরোয়া নৌযান চলাচল রুখে দিয়ে কিছু দুর্ঘটনা কমানো যেতো।
অব্যবস্থাপনা ও নৌযান মালিকদের অতি মুনাফালোভী মনোভাবকে সামনে তুলে ধরেন শিল্পপতি সরফুদ্দিন আহমেদ সান্টু। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার বিজ্ঞাপন প্রচার করে যে তারা দেশকে উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছে দিচ্ছে।
কিন্তু দেশের এতবড় খাত নৌপথ সেখানে যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না। আদি আমলের উদ্ধারকারী সরঞ্জাম ও নৌ নিরাপত্তা ব্যবস্থার পরিবর্তন না করা গেলে প্রতিবছর নৌদুর্ঘটনার যে ধারাবাহিকতা চলমান রয়েছে তা হ্রাস করা সম্ভব নয়।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, এই খাতে নৌযান মালিকদের বিরাট সিন্ডিকেট কাজ করে। যারা খেয়াল খুশি মতো নৌযান পরিচালনা করলেও কেউ তাদের আটকাতে পারে না। এদের নিয়ন্ত্রণ করা গেলে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সহজ হতো। নৌপথ দিনকে দিন যাত্রীসাধারণের জন্য অরক্ষিত হয়ে উঠছে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণের অভাবে।
ব্যবসায়ী শাহিন হাওলাদার বলেন, নৌযান যারা পরিচালনা করেন এবং নৌপথ নিরাপদ রাখতে যারা দায়িত্ব পালন করেন তাদের সবার প্রশিক্ষণ আধুনিক, বাধ্যতামূলক ও যথাযথ কার্যকর করা উচিত। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু সেই তদন্ত কমিটি আলোর মুখ দেখে না।
এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমান্ডার গোলাম সাদেক বলেন, কম টাকা মিলছে অদক্ষ চালক কিংবা সারেং সুকানি। এ ধরনের অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নিচ্ছে। তারা লঞ্চে চালকদের সব সময় নির্দেশনা দিয়ে থাকে।
আর সেই অনুযায়ী চলচল করার কথা কিন্তু অনেক সময় চাকরি বাঁচাতে মালিকের নির্দেশনা মোতাবেক লঞ্চ চলছে। তার প্রতিফলন হচ্ছে মনিং বার্ড লঞ্চ দুর্ঘটনা। এটা দিয়ে প্রতি মালিককে শিক্ষা নেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, লঞ্চডুবির দৃশ্য সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখে মনে হচ্ছে এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ট। এটা চালকের অদক্ষতা প্রমাণ মিলেছে।